মৃত্তিকার উৎপাদন ক্ষমতা : প্রতি ইঞ্চি মাটির ব্যবহার
প্রফেসর ড. মো. সদরুল আমিন
আমাদের মধ্যে অনেকে প্রায় বলে থাকেন একটি স্বাভাবিক উর্বর ও উৎপাদনশীল মাটিতে অন্তত শতকরা ৫ ভাগ জৈবপদার্থ থাকা দরকার অথচ আমাদের দেশের মাটিতে আছে এক ভাগেরও কম। ব্যাখ্যা করা দরকার যে এ কথাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। আমাদের দেশে মৃত্তিকা গবেষণা ও শিক্ষার বয়স প্রায় ৮০ বছর। তবে দেশের উন্নয়নের প্রায়োগিকতায় পেছনে, বুঝা-পড়ায়ও ততটা আধুনিক কনসেপ্ট বহন করে না। রয়েছে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় অসমন্বয়। তাই বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসে মাটির প্রাকৃতিক ও প্রকৃত বিষয়াবলী স্মরণ করে কিছু করণীয় উল্লেখ করা হলো। সম্প্রতি দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- প্রতি ইঞ্চি মাটি চাষের আওতায় আনতে হবে। যে স্থানে যে ফসল ভালো হবে সেখানে সেই ফসল চাষ করতে হবে। এজন্য মাটি সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্বচ্ছ হতে হবে। বাংলাদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি চাষের যথেষ্ট উপযোগী। সাধারণভাবে বলা হয়- বাংলাদেশের মাটি প্রায় দ্বিগুণ উর্বর ও উৎপাদনশীল।
মাটি সম্পর্কে ধারণা
মাটির ধারণা প্রকৃতপক্ষে মাটি ব্যবহারকারীর দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। একজন নির্মাণ প্রকৌশলীর নিকট মাটি হচ্ছে নির্মাণের ভৌত ভিত্তি। একজন ভূতত্ত্ববিদের মতে খনিজের ধারক। কিন্তু একজন কৃষিবিদ মাটিকে ফসল, উদ্ভিদ, মাছ ও পশুখাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করেন। কৃষি বিবেচনায়, উদ্ভিদ ও জীব উৎপাদন সংক্রান্ত তথা উপযোগী ভূত্বকের উপরের নরম অংশকে মাটি বলা হয়। এ ধারণার ভিত্তিতে মাটির একাধিক সংজ্ঞা রয়েছে। যেমন-প্রবীণতম মৃত্তিকা বিজ্ঞানী ডকুচেভ (Dockuchaev) এর মতে: মাটি হচ্ছে খনিজ পদার্থ, জৈব পদার্থ যা জীবকার্যের সমন্বয়ে গঠিত উদ্ভিদ জন্মানোর উপযোগী পরিবর্তনশীল ভূউপরিস্থ একটি প্রাকৃতিক বস্তু। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ অনুসারে মাটি হচ্ছে প্রাকৃতিক বস্তুর সমষ্টি যা ভূপৃষ্ঠকে স্তরাকারে আবরিত করেছে, শিলা থেকে জলবায়ু ও জীবকার্যের সমন্বিত প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে, সময়ের ব্যবধানে পরিবর্তিত হয়ে অবস্থাভেদে বর্তমান রূপ লাভ করেছে এবং যেখানে গাছ জন্মায়। এসব সংজ্ঞার ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়েছে যে মাটির প্রধান ৪টি গঠন দ্রব্যের পরিমাণ। বায়ু ও পানি ৫০%, খনিজ দ্রব্য ৪৫% ও জৈব পদার্থ ৫% (চিএ-১ দ্রষ্টব্য)। মাটিকে আয়তন ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে এই পাওয়া যায়। কিন্তু কৃষির ক্ষেত্রে আমাদের সকল ল্যাবরেটরিতে মাটি বিশ্লেষণ করা হয় ওজনভিত্তিতে। যার ফলাফল ভিত্তি হলো বায়ু ও পানি ২২%, খনিজ দ্রব্য ৭৫% ও জৈব পদার্থ ৩% (চিএ-২ দ্রষ্টব্য)। ওজন ভিত্তিতে জৈবকার্বন নির্ধারণ করে তাকে জৈব পদার্থে রূপান্তর করা হয়। অতএব জৈব কার্বন ৫% এর স্থলে ৩% হতে পারে। প্রকৃত পরিস্থিতিতে সাধারণভাবে যা বলা হয়- বাংলাদেশের মাটি এর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ উর্বর ও উৎপাদনশীল। তবে এই বিষয়টি নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। তাই একাডেমিক ও মাঠ পর্যায়ে মাটি, মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতার বিষয়গুলো পুনরায় একটু স্মরণ করা যেতে পারে।
মাটির উৎপাদন ক্ষমতা
নির্দিষ্ট কৃষি প্রযুক্তি ও কৃষি জলবায়ুতে চাষকৃত মাটির উর্বরতাভিত্তিক নির্দিষ্ট ফসলের ফলন মাত্রাকে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা (টন/হে/বছর) বলে। মাটির উৎপাদনক্ষমতা একটি অর্জিত গুণ। মাটির উর্বরতা, আবহাওয়া, ফসল প্রযুক্তি, সার-সেচ, বালাই মুক্ততা ও কৃষি জলবায়ু সহযোগে মাটিতে ফসলের উচ্চফলন দিতে পারে তাদের সমন্বয়ে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা নির্ধারিত হয় (চিত্র-৩ দ্রষ্টব্য)। উর্বরতা, জলবায়ু, বালাইমুক্ততা, চাষ পদ্ধতি সমন্বয়ে প্রাপ্ত ফলন দ্বারা প্রকাশ করা হয়। ফসল পরিচর্যার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফসল চাষদ্বারা উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো যায়। ফসলের উৎপাদন বিশ্লেষণ করে জানা যায়। উৎপাদন ক্ষমতার মধ্যে সার, ফসল পর্যায় ও বালাই দমন অন্তর্ভুক্ত থাকে। মাটির উৎপাদন ক্ষমতার প্রধান নিয়ামক হলো মাটির উর্বরতা। উৎপাদনশীল মাটিকে অবশ্যই উর্বর হতে হবে।
মাটির উর্বরতা : যে মাটিতে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় সুষম পুষ্টি উপাদান থাকে তাকে উর্বর মাটি বলে। এটি একটি প্রাকৃতিক মৌলিক গুণ। পুষ্টির পরিমাণ ও সুষমতার ভিত্তিতে উর্বরতা প্রকাশ করা হয়। সকল উর্বর মাটি সমভাবে উৎপাদনশীল নাও হতে পারে। মৃত্তিকা পরিচর্যা দ্বারা উর্বরতা বাড়ানো যায়। মাটিতে পুষ্টির পরিমাণ বিশ্লেষণ করে উর্বরতা জানা যায়। ঋতুভেদে তেমন পরিবর্তন হয় না। অম্লমান ও জৈবসার মাটির উর্বরতার প্রধান উপাদান।
মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা : উৎপাদনশীল মাটিকে প্রাথমিকভাবে উর্বর হতে হবে। বেশি উর্বর মাটি ফসলভেদে বেশি উৎপাদনশীল হতে পারে। সঠিকভাবে জমির উপযোগিতা ও আবহাওয়া বিবেচনা করে ফসল নির্বাচন করে উপযুক্ত ফসল পর্যায় অবলম্বন করতে হবে। সুষম সার ও শুষ্ক এলাকায় পানি সেচ-নিকাশ করে অনুৎপাদনশীল মাটির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়। ফসলের উপযোগী জলবায়ুর উপস্থিতিতে উর্বর মাটি উৎপাদনশীল হয়ে থাকে। জমির ফসলের রোগ ও পোকা দমন, আগাছা দমন, গাছের গোড়া আলগা করা, গোড়ায় মাটি দেয়া, প্রভৃতি ফসলের ফলন বাড়ায়।
জাতীয়ভাবে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে মাটি, মাটির উর্বরতা ও সে মোতাবেক উৎপাদন ক্ষমতা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে অন্তত কেপিইটির ১৩টি উপাদান বিবেচনা করা হয়। জমি, মাটি, কৃষি জলবায়ু ও হাইড্রোলজির এসব উপাদানের তথ্য সমন্বয় করে দেশে ৩০টি কৃষি পরিবেশ অঞ্চল (এইজেড) ও ৮৯টি উপ-অঞ্চল গঠন করা হয়েছে (চিত্র-৪ দ্রষ্টব্য)। সারা দেশের কৃষিতে এইজেড ব্যাপক ভূমিকা রাখছে, তবে তা আরো জোরদার করার সুযোগ রয়েছে। দেশে পরিবেশ রক্ষা করে স্থায়ীভাবে উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা প্রণয়নে কৃষি পরিবেশ অঞ্চল তথ্য ব্যবহার করা প্রয়োজন। দেশের মাটি, মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতি ইঞ্চি মাটি ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। তবে উন্নয়নের স্থায়িত্ব রক্ষার্থে দেশে বিশ্বের সকল দেশের অনুরূপ সয়েল কনজারভেশন অ্যাক্ট প্রণয়ন ও প্রতিপালন অত্যাবশ্যক।
লেখক : হাজী মো. দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, দিনাজপুর, মোবাইল : ০১৯৮৮৮০২২৫৩, ই-মেইল :sadrulamin@gmail.com